প্রগতিশীল ধর্মচিন্তক মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খানের সাক্ষাৎকার

 Maulana Wahiduddin Khan In Discussion With ”India Legal” – sogoodislam

মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান: (জন্ম: ১ জানুয়ারি ১৯২৫) ভারতের উত্তরপ্রদেশের আজমগড় এলাকায় জন্মগ্রহণকারী আলোচিত-সমালোচিত ধর্মচিন্তক, পণ্ডিত এবং শান্তি কর্মী। ওয়াহিদুদ্দিন খান ১৯২৫ সালে ভারতের উত্তরপ্রদেশের আজমগড় জেলার বাধরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ফরিদুদ্দিন খান এবং মায়ের নাম জেবুন্নিসা খাতুন। ১৯২৯ সালে তার বাবা মারা যান। তিনি ১৯৩৮ সালে মাদরাসাতুল ইসলাহ নামক একটি প্রথাগত ইসলামিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন এবং ১৯৪৪ সালে সেখান থেকে লেখাপড়া সমাপ্ত করেন। 

 সালমান রুশদি ও মিছিলের রাজনীতি by মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

তিনি দিল্লি থেকে প্রকাশিত মাসিক রিসালা পত্রিকার সম্পাদক। বাংলা ভাষায় তার বেশ কিছু বই অনুবাদ হয়েছে। মূলধারার আলেমদের সাথে তার লেখা-চিন্তায় বেশ কিছু আপত্তি রয়েছে। লেখালেখির পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানগর্ভ আলোচনার জন্যও তিনি ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে জনপ্রিয়।

মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান ২০০০ সালের জানুয়ারিতে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মভূষণ, মাদার তেরেসা জাতীয় নাগরিক পুরস্কার এবং রাজিব গান্ধী জাতীয় পুরস্কার (২০০৯) লাভ করেন। তাকে আবুধাবিতে সাঈদীনা ইমাম আল হাসান ইবনে আলী শান্তি পুরস্কার (২০১৫) প্রদান করা হয়।

উপমহাদেশে বেশ জনপ্রিয়তার পাশাপাশি তিনি ইসলামের মৌলিক কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে সমালোচিতও হোন। 

এই বিতর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কীত তার একটি সাক্ষাৎকার বেশ ক'বছর আগে Khabar South Asia  প্রকাশ করে। নিচে সাক্ষাৎকারটির বঙ্গানুবাদ দেওয়া হলো-

খবর: আপনি বর্তমান বিশ্বে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে কিভাবে দেখেন?

খান: ইসলাম সমতা, শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের কথা বলে, কিন্তু সমসাময়িক কালে, বিদেশিদের প্রতি অহেতুক ভয় মুসলমান সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করেছে। ইসলাম মুসলমানদেরকে শান্তি ও ভ্রাতৃত্ববোধের দূত হওয়ার জন্য আহ্বান জানায়, কিন্তু এর বিপরীতে মুসলমানদের একটা অংশ চরমপন্থা ও কুসংস্কারের সাথে জড়িত রয়েছে। ইসলামে অসহিষ্ণুতা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য, এবং মুসলমানদের উচিত সহিষ্ণুতা দেখানো এবং সবরকম পরিস্থিতিতে শান্তি ও ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখা।

খবর: মুসলমান আলেমরা কি ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধের বিস্তারে তাদের ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে? নবী মোহাম্মদ বলেছেন, "যখন নেতা ও আলেমরা সঠিক পথে থাকবে, তখন জনসাধারণও সেই একই পথে থাকবে"৷

খান: মুসলমান আলেমরা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার প্রবণতা রয়েছে এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা দাওয়ার (ইসলামের আসল মূল্যবোধকে যথাযথভাবে তুলে ধরা, উপলব্ধি ও মূল্যায়ন করা) মহৎ দায়িত্ব থেকে দূরে থেকেছেন। আমার মতে, তারা এই ধর্ম সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর করতে ব্যর্থ হয়েছেন, এবং মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক নৈতিক অধঃপতন ডেকে আনতে ভূমিকা রেখেছেন।

ইসলাম ন্যায়বিচার, শান্তি ও সম্প্রীতির পক্ষে৷ইসলামে চরমপন্থা অনুমোদনযোগ্য নয়। আলেমদের ভূমিকা সম্পর্কে নবী মোহাম্মদ (সাঃ) বলেন, "ওলামা (আলেম) হলেন তিনি যিনি যুগ সম্পর্কে এবং তিনি যে সব জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন তাদের সম্পর্কে জানেন"৷ যখন আলেমরা বিশ্বের ঘটনাবলী সম্পর্কে অসচেতন বা অমনোযোগী হন, তখন তাদের অন্তর্দৃষ্টি ও প্রজ্ঞার অভাব হতে বাধ্য।

খবর: ইসলামে জিহাদের ভূমিকা নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি রয়েছে। জিহাদ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আসলে কি বলা হয়েছে?

খান: জিহাদ অর্থ হলো দাওয়া। মানুষ জিহাদের ধারণাকে ভুল বুঝেছে। ইসলাম সুস্পষ্টভাবেই চরমপন্থা অবলম্বনের অনুমতি দেয় না, কিছু বিবেকহীন লোক জিহাদের ভুল ব্যাখ্যা করেছে। যারা যে কোনো কারণে মানুষ হত্যা করে তারা সন্ত্রাসী ও অপরাধী। তারা কোনোভাবেই ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে না বরং তাদের নিজেদের এজেন্ডা ও লালসার প্রতিনিধিত্ব করে। কোনো মানুষের জীবন কেড়ে নেয়ার অধিকার কারো নেই। মানবজাতি সর্বশক্তিমান আল্লাহর মালিকানাধীন, তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং জীবন হরণের একমাত্র কর্তৃত্ব [অধিকার] তারই। কোরআন মুসলমানদেরকে "মধ্যপন্থী সম্প্রদায়" হিসেবে বর্ণনা করে এবং তাদেরকে অন্য সম্প্রদায়গুলোর লোকজনের প্রতিও ক্ষমাশীল, দয়ালু ও সহিষ্ণু হওয়ার জন্য সনির্বন্ধভাবে আহ্বান জানায়।

খবর: আপনি বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতাকে কিভাবে দেখেন? এই ধরনের অমানবিক কাজের জন্য কারা দায়ী বলে আপনি মনে করেন?

খান: অপরাধী ও সন্ত্রাসীরা এই ধরনের অমানবিক কাজ করে থাকে। এই ধরনের চরমপন্থীদের কোনো ধর্ম নেই। তাদের নিজেদের কায়েমী স্বার্থের জন্য করা এই সব অমানবিক কাজগুলোর জন্য আমাদের নিন্দা জানানো উচিত।

খবর: কি পরিস্থিতিতে এবং কোন অপরাধগুলোর জন্য ইসলামে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদিত?

খান: সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানুষকে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের জীবন হরণ করা বা মানুষকে হত্যা করার জন্য কারো অনুমতি নেই। কাউকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হলে ইসলামে মৃত্যুদণ্ডের অনুমতি রয়েছে।

খবর: ইসলামে ব্লাসফেমি সম্পর্কে কী আইন রয়েছে? ব্লাসফেমি মোকাবেলা করার জন্য কি মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র উপায়?

খান: ব্লাসফেমি সম্পর্কে ইসলামে কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। মুসলমানদের সহিষ্ণুতা দেখানো ও প্রজ্ঞা প্রদর্শন করা উচিত। ইসলাম-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ডেনিশ কার্টুনিস্ট (কুর্ট ওয়েস্টারগার্ড) ও সালমান রুশদির বিরুদ্ধে সহিংস বিক্ষোভ ছিল শক্তির অপচয়। যদি কেউ নবী মোহাম্মদ (সাঃ) এর বিরুদ্ধে লেখে, তার মিথ্যা প্রচারণাকে উৎখাত করা এবং তাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য আমাদের প্রকৃত জ্ঞান থাকা উচিত। যে সব বিবেকহীন ব্যক্তি ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরি করতে চায় তাদের মোকাবেলা করার জন্য আমাদেরকে যুক্তি ও কারণ নিয়ে সুসজ্জিত থাকতে হবে।

প্রথমদিকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারা নবী মোহাম্মদ (সাঃ) এর বিরোধী ছিলেন। নবী মোহাম্মদ (সাঃ) কখনোই তাদের বিরুদ্ধে রাগ দেখাননি বা তাদেরকে কোনো প্রকার শাস্তি দেননি। উচ্চ মূল্যবোধ ও চারিত্রিক বিশুদ্ধতা দেখিয়ে নবী মোহাম্মদ (সাঃ) তার শত্রুদেরকে অনুগামী ও বিশ্বস্ত বন্ধুতে পরিণত করেছিলেন।

খবর: ইসলামে হিজাব (পর্দা)-এর তাৎপর্য কী? স্কুলে ও কলেজে মেয়েদের মাথা ঢেকে রাখা কি বাধ্যতামূলক? বেশিরভাগ পশ্চিমা কলেজে পর্দা করার অনুমতি নেই।

খান: বর্তমানকালে নারীরা ও মেয়েরা যা পরছে তা হিজাব নয়। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব নিয়ম-কানুন রয়েছে। ছাত্রীদের উচিত সেই সব নিয়ম-কানুনগুলো অনুসরণ করা ও মেনে চলা। ইসলাম কোনো পরিস্থিতিতেই কোনো প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকে সমর্থন করে না। যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের কিছু নিয়ম-কানুন আপনার পছন্দ না হয়, তার অর্থ এই নয় যে আপনি আপনার নিজস্ব নিয়ম-কানুন বাস্তবায়নের মাধ্যমে অন্যদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করবেন।

ইসলাম আপনাকে সৎ ও সম্মানিত নাগরিক হতে সনির্বন্ধভাবে আহ্বান জানায়। সবার উচিত তার নিজের দেশের প্রতি অনুগত থাকা এবং একইভাবে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারী আইন-কানুনগুলো মেনে চলা। আপনি আপনার দেশের একজন ভালো নাগরিক না হলে আপনি কখনোই একজন ভালো মুসলমান হতে পারবেন না।

খবর: শান্তি ও শিক্ষার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে আপনি মাদ্রাসাগুলোর কী ভূমিকা দেখতে পান?

খান: মাদ্রাসাগুলোর ভূমিকা সীমিত এবং তারা এর বাইরে যেতে পারবে না। মাদ্রাসাগুলো নোবেল বিজয়ী, বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও সংস্কারবাদী তৈরি করবে বলে আপনি আশা করতে পারেন না। মাদ্রাসাগুলো আপনাকে নামাজ ও হজ্জ (প্রার্থনা ও তীর্থযাত্রা) করা সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তি ও প্রকৌশলের ক্ষেত্রে বিখ্যাত ব্যক্তি তৈরি করার জন্য জাগতিক জ্ঞান অবশ্যই প্রয়োজনীয়, এবং ইসলাম এর বিরোধী নয়।

সাক্ষাৎকারটি ইংরেজিতে পড়তে এখানে ক্লিক করুন। মূল সাইটের (Khabar South Asia) সাক্ষাৎকার টি কারিগরি ত্রুটির ফলে তাদের সাইট হতে মুছে গেছে।

 

মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খানের বিরুদ্ধে যত সমালোচনা:

মুহাম্মদ মতীন খালেদের সংকলন ও সম্পাদনায় ‘ইলম ও ইরফান পাবলিকেশন্স, লাহোর’ হতে প্রকাশিত ‘মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান : ইসলাম দুশমন শখসিয়ত’ নামক একটি গ্রন্থে মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খানের বেশ কিছু সমালোচনা উঠে এসেছে।  

সংকলক ও সম্পাদক বইটির শুরুতে লেখেছেন,
‘মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান_
* যিনি কখনও নবী করীম সা.-এর ফযীলত অস্বীকার করেন।
* কেউ প্রিয় রাসূলের শানে ঔদ্ধত্বমূলক কথা বললে তাকে তিনি ‘লেখকের বাকস্বাধীনতা’ ও ‘মানবাধিকার’-এর ধুয়ো তুলে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
* কখনও সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে অসমীচিন ও অসংলগ্ন কথা বলেন।
* কখনও সালাহ উদ্দীন আইয়ুবী, টিপু সুলতান, সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রহ.-এর মতো সুমহান সৈনিকদের সম্পর্কে নিন্দাবাক্য বলেন।
* কখনও আওরঙ্গজেব, সাইয়্যেদ জামালুদ্দীন আফগানী, সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী, হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রহ. ও তাঁর পরিবার-পরিজনের সংস্কার আন্দোলন ও শুদ্ধিসংগ্রাম সম্পর্কে কটাক্ষ করেন।
* কখনও তিনি ভারতে বাবরী মসজিদের ধ্বংসযজ্ঞ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্যে স্রেফ মুসলমানদেরকেই দোষারোপ করেন।
* কখনও মাওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার, আল্লামা ইকবাল, আলতাফ হুসাইন হালী, মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী, সাইয়্যেদ আতাউল্লাহ শাহ বুখারী ও জিন্নাহ প্রমুখ মহান রাজনীতিবিদ ও দেশনেতাদের সম্পর্কে অশালীন কথা বলেন।
* কখনও কাশমির, ফিলিস্তিন, বসনিয়া, কসোভো, চেচেনিয়া ও ইরিত্রিয়ার মুসলমানদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ঘৃণার চোখে দেখেন।
* সালমান রুশদি, তাসলিমা নাসরীনদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের গণরোষকে যিনি বর্বর ও উন্মাদনা হিসেবে অভিহিত করেন।
* কখনও তিনি ইজতিহাদের নামে দ্বীনবিকৃতির বৃথা কসরত করেন।
* কখনও তিনি 1857 সালের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ইংরেজবিরোধী চক্রান্ত অভিহিত করেন।
* কখনও তিনি অখণ্ড ভারতের শ্লোগান তুলে দেশভাগকে ঐতিহাসিক ভুল বলার ধৃষ্টতা দেখান।
* যাকে প্রায়সময় আরএসএস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের চরম সাম্প্রদায়িক হিন্দু নেতাদের স্বপক্ষে অবতীর্ণ হতে দেখা যায়।
* কখনও তাকে ইসলামি ফেকাহ সংশ্লিষ্ট কিতাবাদি সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতে দেখা যায়।
* কখনও যাকে দ্বীনে আকবরির প্রতিষ্ঠাতা, ইসলামবৈরী শাসক সম্রাট আকবরের পতাকা হাতে আবির্ভূত হতে দেখা যায়।

 ---------------------------------------------------

 

 

 

 

 

Comments

Popular posts from this blog

সৌদি জোটের সামরিক আগ্রাসনের পর ইয়েমেনের কোন অংশ কারা নিয়ন্ত্রণ করছে?

‘ব্র্যাক’ এদেশে কি প্রতিষ্ঠা করতে চায়?

Midnight Massacre in Dhaka by Security Forces of Bangladesh [WARNING GRAPHIC VIOLENCE]