সৌদি জোটের সামরিক আগ্রাসনের পর ইয়েমেনের কোন অংশ কারা নিয়ন্ত্রণ করছে?

 


দরিদ্র রাষ্ট্র ইয়েমেনের সাথে ঐ অঞ্চলের প্রভাবশালী রাষ্ট্র তাদের প্রতিবেশী সৌদি আরবের রয়েছে দীর্ঘ কয়েক দশকের শত্রুতা!

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতা পতনের পর ইবনে সৌদ যখন আধুনিক সৌদি আরব প্রতিষ্ঠা করেন তখন ইয়েমেন বাদে প্রায় সব আরব এলাকা নিজের নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন। পরবর্তীতে সৌদি আরব ও ইয়েমেনের মধ্যে ১৯৩৪ সালেও একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে এরপর পেরিয়ে গেছে বহু বছর। 

২০১১ সালের ২৭শে জানুয়ারি। আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তখন ক্ষমতা পরিবর্তনের দাবিতে যে গণঅভ্যুত্থান চলছিল - তার ঢেউ এসে পৌছালো ইয়েমেনে। রাজধানী সানার রাস্তায় নেমে এলো হাজার হাজার মানুষ। এই পরিস্থিতিতে আরব বসন্ত ঠেকানো খুবই জরুরি হয়ে পড়েছিল সৌদিসহ বেশিরভাগ আরব দেশের শাসকদের জন্য। সৌদি আরবের সীমান্তের পাশের প্রতিবেশি ইয়েমেনে যদি তাদের মদদপুষ্ট স্বৈরশাসকের পতন ঘটে তাহলে সৌদি রাজতন্ত্রের জন্য তা বিরাট হুমকি হয়ে উঠতে পারে। যেকোনো সময় আরব দেশগুলোতে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ ঘটতে পারে। সেই আশংকা থেকে সৌদি আরব এ অঞ্চলে তার মিত্রদেরকে নিয়ে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। 



আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সহায়তা নিয়ে সৌদি আরব সেই গণজাগরণ ঠেকাতে মাঠে নামে। পেছন থেকে কলকাঠি নাড়তে থাকে সন্ত্রাসবাদী অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েল। সে সময় ইয়েমেনে ৩৩ বছর ক্ষমতায় থাকা স্বৈরশাসক সালেহকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেয় সৌদি আরব ও তার অনুসারিরা। যদিও গণবিক্ষোভের মুখে পরবর্তীকালে ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন দীর্ঘ ৩৩ বছরের স্বৈরশাসক আলি আবদুল্লাহ সালেহ। জাতিসংঘের দেওয়া তথ্যমতে, সালেহ কমপক্ষে বিশটি দেশে লুকিয়ে রাখা ৩২-৬০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদের মালিক ছিল। একটা মজার তথ্য হলো, সৌদি আরবের মদদপুষ্ট স্বৈরশাসক সালেহ শিয়া ছিলেন। যিনি পরবর্তীতে নিজ স্বার্থ রক্ষায় হুথিদের সাথে যোগও দিয়েছিলেন।  ২০১৫ সালে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেনে হুতিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করলে সালেহ হুতিদের সাথে জোট বাঁধেন ও সৌদি জোটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত হন। কিন্তু পরবর্তীতে আবারো হুথিদের সাথে তার বাহিনীর বিরোধ দেখা দেয়ার পর তার বাহিনীর সাথে হুথি বিদ্রোহীদের লড়াই শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর হুতি বিদ্রোহীদের হামলায় ইয়েমেনের এই সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ নিহত হয়েছিল। সৌদি জোট তার সমর্থনে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েও তাকে রক্ষা করতে পারেনি।

এর আগে ২০১৫ সালে হুতিরা ইয়েমেন দখল করে সানায় নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করে এবং সৌদিপন্থী ইয়েমেনের সেই সময়ের  প্রেসিডেন্ট হাদি (ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট সালেহ'র উত্তরসূরী) বন্দরনগরী এডেনে তার সমর্থকদের নিয়ে অবস্থান নেয় যাদেরকে পরবর্তীতে সৌদি আরব সহায়তা করে। সৌদি সমর্থিত এই সাবেক  প্রেসিডেন্ট মনসুর আল হাদি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাকে সামরিক সমর্থনের লক্ষ্যে ইয়েমেনে সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করে সৌদি আরব। এই অবৈধ সামরিক হস্তক্ষেপে তাদেরকে পূর্ণ ভাবে সহায়তা করে আমেরিকা। আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসাও বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছিল। বর্তমান পৃথিবীর পঞ্চম সর্বোচ্চ সামরিক খরচ বহনকারী দেশ সৌদি আরব। যার আশপাশেও নেই কোন মুসলিম রাষ্ট্র।

ইয়েমেনে সৌদি আরবের এই সামরিক হস্তক্ষেপ শুরুর কয়েক মাসের মাথায় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের কথা বলে ইসলামিক মিলিটারি কাউন্টার টেররিজম কোয়ালিশন (আইএমসিটিসি) নামের একটি সামরিক জোটের ঘোষণা দেয় সৌদি আরব। সৌদি নেতৃত্বাধীন এ জোটের সচিবালয় রিয়াদে অবস্থিত। বর্তমানে বাংলাদেশসহ ৪১টি দেশ এই জোটের সদস্য। সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান ওই জোটের প্রধান। ওই জোটের সহায়তাকারী রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স রয়েছে। 





২০১৫ সালের ২৬ মার্চ রাতের বেলা সৌদি আরবের নেতৃত্বে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, মরক্কো, কুয়েত, বাহরাইন, কাতার, ও জর্দানের সম্মিলিত বিমান বাহিনী ইয়েমেনের ওপর হামলা শুরু করার পর একে একে গুঁড়িয়ে যেতে থাকে ইয়েমেনের শহর, বন্দর গ্রাম-জনপদ। সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে ইয়েমেন থেকে তেল ও তরল প্রাকৃতিক গ্যাস লুট করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও রয়েছে। প্রায় ৭ বছর ধরে ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত এলাকার জল, স্থল ও আকাশপথের ওপর কঠোর অবরোধ আরোপ করে রেখেছিল সৌদি আরব। ইয়েমেনের ঐ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকার উৎস হুদায়দা সমুদ্রবন্দরের ওপর অবরোধ আরোপ করে রাখার কারণে দারিদ্রপীড়িত দেশটির অর্থনৈতিক দুরবস্থা চরমে পৌঁছেছিল। সৌদি নেতৃত্বাধীন বাহিনী প্রায়ই ইয়েমেনের জন্য আমদানি করা তেলসহ অন্যান্য জরুরি পণ্য সামগ্রী জব্দ করে নিয়ে যেত। 

এ কাজে আগ্রাসী সৌদি জোটকে প্রকাশ্যে লজিস্টিক ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছিল আমেরিকা। এই যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ নিহত বা আহত হয়েছে, যার মধ্যে ১০ হাজারের বেশি শিশু রয়েছে। জাতিসংঘ এই যুদ্ধের ফলে প্রায় ৩ লক্ষ ৭৭ হাজার মানুষ নিহতের দাবি করেছিল। কোটি কোটি মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছিল, লক্ষ লক্ষ মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিল। সেই সঙ্গে দেশটির বেশিরভাগ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়েছিল। এদিকে এত ব্যাপক হামলার পরেও আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় ২০২২ সালের ৯ মার্চ সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট সামরিক পরাজয়ের কারনে এই আগ্রাসন থেকে পিছু হটেছিল। 

পরবর্তীতে তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে এখন ইয়েমেন শাসিত হচ্ছে। একদিকে আছে হুথি বিদ্রোহীরা। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত সৌদি জোট সমর্থিত সরকার। এছাড়াও বন্দরনগরী এডেনসহ আরেকটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল নামে গঠিত দক্ষিণাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। শুরুতে এরা রাজধানী সানার দখলে থাকা হুতি বিদ্রোহীদের দমনে সৌদি জোট সমর্থিত সরকারের পক্ষে ছিলো। পরবর্তীতে আস্থার সম্পর্ক গড়ে না ওঠায় তারা সৌদি সমর্থিত সরকারি বাহিনীর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এরা সরাসরি আরব আমিরাতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এখন ইয়েমেনে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের বেশ কয়েকটি মিলিটারি বেইস রয়েছে। 

Comments

Popular posts from this blog

‘ব্র্যাক’ এদেশে কি প্রতিষ্ঠা করতে চায়?

Midnight Massacre in Dhaka by Security Forces of Bangladesh [WARNING GRAPHIC VIOLENCE]